বিয়ে নয়, ডেটিং-লিভ টুগেদারে আগ্রহ বাড়ছে চীনা যুবক-যুবতীর।
তথ্য বলছে, চীনের যুবক-যুবতীরা বিয়ে করছেন অনেক দেরি করে। সেখানে বিবাহ বিচ্ছদের হার বাড়ছে। তার চেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষ সিঙ্গেল থাকাকেই বেশি পছন্দের মনে করছেন। তরুণ তরুণীরা বলছেন, তারা আধুনিক জীবনযাপনের সঙ্গে বিয়েকে বেমানান হিসেবে দেখছেন।
সাংহাইয়ের ২৬ বছর বয়সী ইউ ঝাং বলেছেন, চীনে বিয়ে হলো একরকম মারা যাওয়ার মতো।
ঝাং ল্যাবরেটরির একজন টেকনিশিয়ান। দু’বছর ধরে গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে একসঙ্গে দিন কাটাচ্ছেন। তবে তাদের মধ্যে বিয়ে নিয়ে খুব কমই কথা হয়।
তারা যখনই বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেন, তখন এই উপসংহারে আসেন যে- ‘বিয়ের চিন্তা আমাদেরকে সুখে থাকার চেয়ে বেশি হতাশাগ্রস্ত করে’। তারা বিয়েকে দেখেন দুটি পরিবারের একত্রিত হওয়া হিসেবে। পাশাপাশি একটি বাড়ি কেনা এবং একটি পরিবার শুরু হিসেবে। এই মুহূর্তে এসব ভাবনাকে তারা অবাস্তব হিসেবে দেখেন। ঝাং বলেন- আমার মা এবং ওর পিতামাতা একে অন্যকে পছন্দ করে না। এখন বাসাবাড়ির বাজারও ভাল না। আর একটি পরিবার শুরু করতে গিয়ে একটি সন্তান বড় করা খুবই ব্যয়বহুল।
করোনা মহামারির বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার পর ঝাং ও তার প্রেমিকা প্রিয় সব রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়া এবং পুরো চীনে ঘুরে বেড়ানোকে আনন্দের হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তিনি বলেন, যদি আমাদের বাসা থাকতো তার এবং আমাদের সন্তানদের লালনপালনে খরচ করতে হতো। এসব করার মতো অর্থ ও সময় কোনোটাই নেই আমাদের।
ঝাং এবং তার প্রেমিকার মতো যুগলদেরকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করাতে উৎসাহিত করছে স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে সরকার। কিন্তু তারা এতে যথেষ্ট সফল হচ্ছে না। মে মাসে চীনের কমপক্ষে ২০টি শহরে এ বিষয়ক পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।
ঝেজিয়াং প্রদেশের একটি কাউন্টি গত মাসে নববিবাহিত কনের বয়স যদি ২৫ বছর বা তারও কম হয় তাহলে তাকে অর্থ পুরস্কার দেয়ার প্রস্তাব দেয়। সরকারিভাবেও উপযুক্ত বয়সে বিয়ে করতে যুবক-যুবতীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে, সন্তান নিতে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। চীনের জনপ্রিয় সংস্কৃতিতেও এর ছোঁয়া দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি টিভি শো এবং ফ্যাশন স্টাইলের কেন্দ্রে থাকে বিয়েতে গুরুত্ব দেয়া।
গুয়াংঝু সিটির জেসিকা ফু (৩১) বিশ্বাস করেন সরকার বিয়েতে যে মনোযোগ দিয়েছে তা হলো দেশের জন্মহার বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে। জেসিকা ফু মার্কেটিং সমন্বয়ক। তিনি বলেন, চীনা সমাজে বিবাহিত দম্পতিরাই প্রধানত সন্তান নেন। বিয়ের হার কমে যাওয়ার কারণে সন্তান জন্মহার কমে গেছে। এর ফলে চীনে জনসংখ্যাতত্ত্বে সংকট সৃষ্টি করেছে। যদি অদূর ভবিষ্যতে এই ধারার পরিবর্তন করা না হয়, তাহলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে। বর্তমানে সরকারের স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন, বিয়েতে সরকারি প্রণোদনা এসবের কিছুই জেসিকা ফুকে আস্থায় নিতে পারছে না। তিনি বলেন, বিয়ে চীনের মানুষের জীবনে যে পরিবর্তন আনে, তা আমি পছন্দ করি না। তিনি স্মরণ করেন তার পিতামাতা কি এক অসুখী বিবাহিত জীবন পার করেছেন। তা সত্ত্বেও তারা একসঙ্গে ছিলেন। কারণ, তারা বিচ্ছেদকে দেখতেন লজ্জার। জেসিকা বলেন, সম্প্রতি আমার এক কাজিন বিয়ে করেছেন। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে তীব্র চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, একজন চীনা বধু হয়ে ঘরে থাকতে। তাই জেসিকা মনে করেন, একদিন তিনি যোগ্য একজন পার্টনার খুঁজে পাবেন এবং তার সঙ্গে বাকি জীবন শেয়ার করবেন। কিন্তু বিয়ে করবেন না।
অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের চাইনিজ ও এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ের সিনিয়র লেকচারার প্যান ওয়াং। তিনি লিখেছেন ‘লাভ অ্যান্ড ম্যারিজ ইন গ্লোবালাইজিং চায়না’ বই। তিনি বলেন, বিয়ের ক্ষেত্রে চীনাদের ব্যক্তিগত পছন্দ সমাজকেই বদলে দিচ্ছে। বর্তমানে জীবনধারার অনেক অপশনের মধ্যে বিবাহিত জীবন হলো একটি ধারা। চীনে এখন সিঙ্গেল অর্থনীতি। আগে চীনাদের কাছে অবিবাহিত থাকার কোনো সুযোগ ছিল না। অনেক বিয়ের আয়োজন করেছেন পিতামাতা ও পরিবার। ম্যাচমেকিং বা ঘটকালিতে জড়িত থাকতেন প্রবীণরা, কর্মক্ষেত্রের ম্যানেজাররা অথবা প্রতিষ্ঠান। প্রথম প্রজন্মের চীনাদের কাছে ভালবাসা এবং বিয়ে কোনো ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় ছিল না। কিন্তু ১৯৯০ এর দশকে নারী ও পুরুষের শিক্ষায় জোর দেয়া হয়।চীন উদার ও আধুনিকায়ন হয়। অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে। এসব কারণে দ্রুততার সঙ্গে চীনের সমাজ ব্যবস্থা বদলে যায়। লাখ লাখ ছেলে ও মেয়ে কাজের জন্য বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়েন।
১৯৮০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বহাল থাকে এক সন্তান নীতি। এর ফলে পরিবারগুলো শুধু ছেলে সন্তানকেই বেছে নেয়। খুব কম পরিবারই চেয়েছে তাদের সেই একটি সন্তান মেয়ে হোক। এমন পরিবর্তিত সমাজে নারীদের একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে ওঠে, যারা তাদের শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দেন। তারা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবেশের লক্ষ্য স্থির করেন। সুযোগ এবং সম্পদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। এমনি করে তারা সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অর্জন করেছেন আর্থিক নিরাপত্তা।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের সহকারী প্রফেসর মু ঝেং বলেন, জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো বিয়েকে। কিন্তু এখন আর তা হয় না। চীনে বিয়ে এবং পারিবারিক আচরণের বিষয়ে গবেষণায় দৃষ্টি দিয়ে ঝেং বলেন, সরকারের নীতি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চারপাশের অর্থনৈতিক পরিবেশ এবং নারী-পুরুষের জীবন বেছে নেয়ার পথকে বদলে দিয়েছে। নারী এবং পুরুষ উভয়েই এখন পরিবারের বাইরে গিয়ে কঠোর কাজ করতে চান। এসব প্রত্যাশার কারণে বদলে গেছে সব।